আগ্রাসী থাবা ঋণখেলাপিদের

 

ব্যাংক খাতের অনেক উন্নতি হয়েছে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে । মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে সেবা সমূহ I আমানত ও ঋণ বিতরণ বেড়েছে I ভিন্নতা  এসেছে সেবা সমূহে । সর্ব ক্ষেত্রে  অর্থনৈতিক বিকাশে রাখছে অনন্য অবদান। করোনার ক্ষয়,ক্ষতি  থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যাংকিং খাতের  অসামান্য অবদান ও রয়েছে I

এতকিছুর মধ্যেও খাতটিকে তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলেছে ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্য। তাদের আগ্রাসী থাবায় জর্জরিত ব্যাংক খাত। দীর্ঘ সময়ে ঋণখেলাপির সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে খেলাপি ঋণ। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।

ইতো  মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা বিলীন  করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যা  খেলাপি ঋণের ৮৯ শতাংশ মোট।

১৯৮৬ সালে নীতিমালা প্রণয়ন হয়, ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা প্রণীত না হওয়ায় স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ঋণ শ্রেণিকরণ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে হয়নি। পরবর্তী  থেকে ঋণ একটি নির্দিষ্ট সময়ে আদায় না হলে তা খেলাপি হিসাবে গণ্য হয়। পরে সংস্কারের মাধ্যমে এ নীতিমালা আরও আধুনিকরণ করা হয়েছে। এর অধীনে  এখন আদায় পরিশোধ না হলে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত বা নির্বাচিত করা হচ্ছে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১২টি ব্যাংক ছিল, স্বাধীনতার পূর্বে । সবগুলো  কে একত্রিত  করে ১৯৭২ সালে প্রণীত ব্যাংক জাতীয়করণ অধ্যাদেশ বলে সরকারিকরণের মাধ্যমে ছয়টি ব্যাংক গঠিত  করা হয়। ব্যাংক গুলো গুলো হচ্ছে-সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, উত্তরা ও পূবালী ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি  ৬০টি হয়েছে। এখন প্রায় সব ব্যাংকেই খেলাপি ঋণের থাবা বসেছে। এমন কি এ  প্রজন্মের ব্যাংকগুলোকে ও  খেলাপি ঋণের করাল গ্রাসে পড়তে হচ্ছে ।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণখেলাপিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৫২৮ জনে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী। একই সময়ে ছিল ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৯৮২ জন, ২০২০ সালের । ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে গত এক বছরে ২৫ হাজার ৫৪৬ জন। ২০১৮ সালের জুনে এ সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ জন। দুই বছর তিন মাসে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৩২৪ জন। ইতো মধ্যে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে দুই ধরনের ঋণখেলাপিই রয়েছেন। মূলত বড় ঋণের পাশাপাশি এখন ছোট ঋণও খেলাপি হচ্ছে। এটা ছাড়া অনেক খেলাপির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। বিদেশে পাচার করে দেওয়ায় খেলাপি হয়েছে, অস্তিত্ববিহীন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঋণ ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য আড়াল করছে, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলসহ (আইএমএফ) এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে আসছেন । বাস্তবে খেলাপি ঋণ আরও বেশি।  কোনো ঋণ পরিশোধের সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেলে সেগুলো বিশেষ হিসাবে স্থানান্তর করা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী I কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার ছয় থেকে নয় মাসের মধ্যে পরিশোধিত না হলে তা খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

বিশ্লেষক ও আইএমএফ এর  মতে, বিশেষ হিসাবে থাকা ঋণও খেলাপি হিসাবে ধরা উচিত। কেননা এগুলোও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে ছয় থেকে নয় মাসের মধ্যে । ৪৭ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা হিসাবে রয়েছে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এছাড়া অবলোপন করা আছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। । আটকে আছে ৮০ হাজার কোটি টাকার ঋণকে খেলাপি হিসাবে দেখানো সম্ভব হচ্ছে না, আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে । ২১ হাজার কোটি টাকা আবারও খেলাপির পর্যায়ে চলে গেছে, বিশেষ বিবেচনায় নবায়ন করা ঋণের মধ্যে I এগুলোও খেলাপি হিসাবে গণ্য করার মতো। । কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করে না। প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ৯২ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের প্রায় ২৪ শতাংশ সব মিলিয়ে ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ব্যাংকিং খাতকে প্রতিযোগিতা করতে হলে মান ও সুশাসনে আরও উন্নত করতে হবে। প্রকৃত খেলাপি ঋণ কমাতে হবে । প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। বৈদেশিক লেনদেনে তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি লাগবে না দেশের ব্যাংকিং খাত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা পেলে । তখন কমে যাবে ব্যাবসায়িক খরচ । বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের ২৪ জুন আদালতে দেওয়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে খেলাপি ও অকার্যকর ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা, এর মধ্যে সরাসরি খেলাপি ঋণের পরিমাণ । বাকি ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে বিভিন্ন আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। ৩০ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে যাতে এসব ঋণ খেলাপি করা না হয় ।

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য ঋণ বিতরণের অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, সুশাসনের অভাবকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, পাকিস্তান আমলেই ব্যাংকগুলোতে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি জেঁকে বসেছিল। ঋণের সিংহভাগই কেন্দ্রীভূত ছিল। স্বাধীনতার পর এ অবস্থার উন্নতি হয়নি। বরং অবনতি হয়েছে। ব্যাংকের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সেবার পরিধি। একই সঙ্গে বেড়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতিও। এসব মিলে বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ।